শেষ ফোন – জলফড়িং

SeshPhone-JolPhoring-Meghpori-Bangla-Kobita

(১)

হ্যাঁ, হ্যালো দীপ?

— আমি শ্রেয়……..
— কট্ করে ওপাশের লাইনটা কেটে গেলো।

কাঁপা কাঁপা হাতে দীপ যখন ফোনটা রেখে ছাদে এলো তখন গ্রীষ্মের সন্ধ্যার দক্ষীনমুখী বাতাস ওর ওপর হুমড়ি খেয়ে পড়লো,যদিও কপালের ঘামের ছাপ তাতে গেলো না।

(২)

দোতালার বারান্দার রেলিং ওপর ঝুঁকে বছর পঞ্চান্নের লোকটি যখন শঙ্খ কে বড়ো বড়ো চোখ পাকিয়ে লক্ষ্য করছিলো, তখন শঙ্খ একতলার বারান্দা থেকে পাশের বাড়ির দোতালায় শিবানীর ঘরের জানায় চিরকুট ছুড়তে ব্যাস্ত।
অন্য সময় হলে তাকে ওপরে ডেকে শুভ্রদীপ বাবু খুব করে কথা শুনিয়ে দিতেন। কিন্তু আজ অনেকদিন পর দ্বিতীয়বার তার মন বারন মানলো না।

শঙ্খ শেষ চিরকুটটা ছুড়তে যাবার আগেই দুপুরের রোদে কার যেনো ছায়া তার মাথায় এসে পড়লো,তা লক্ষ্য করে ওপরে তাকাতেই কেমন যেনো আড়ষ্ট হয়ে গেল সে কোনরকমে শরীরের সমস্ত জোর লাগিয়ে দৌড়ে নিজের ঘরে ঢুকে পড়লো।

ধরা পড়ে যাওয়ার ভয়ে যখন তার হাত পা রিতীমত কাঁপতে শুরু করেছে তখন হাজারো প্রশ্ন তার মাথায় ভিড় করে এলো।

কে জানে শুভ্র বাবু তার বাড়িতে ফোন করে বলে দেবে নাতো পড়াশোনার নাম করে থাকতে এসে সে প্রেম করছে!

নাকি তাকে এখুনি ডেকে পাঠাবে ওপরে?

কি করা যায় কি উত্তর দেওয়া যায় এই ভাবতে ভাবতেই হঠাৎ শঙ্খ দেখলো অনেকটা সময় পেরিয়ে গেছে, যদি তাকে সত্যি কিছু বলার থাকতো তাহলে নিশ্চয়ই এতোক্ষনে  তাকে ডেকে ফেলতো।

এই শুভ্রবাবুকে বোঝা খুব দুষ্কর ব্যাপার, তিনি সব সময় এমন গম্ভীর আর চুপচাপ থাকেন কখনোই সাহস করে কথা বলতে এগিয়ে আসেনা কেউ, তাই শঙ্খরও কখনো সে সুযোগ হয়নি। পাড়ার লোকের সাথেও দরকার ছাড়া খুব একটা কথা বললেন না,তাবলে কারোর সাথে খারাপ ভাবও তার নেই।

শুভ্রবাবুর ব্যাপারে পাড়ার লোকজনও বেশি কিছু কেউ জানে না। যেটুকু জানে তা খানিকটা এরকম–

শুভ্রদীপ বাবু অবিবাহিত, বছর সাতেক আগে তার মা গত হন, তখন তিনি শহরে থাকতেন, সরকারি কোন দপ্তরে উচ্চ বিভাগে ছিলেন বলেই শোনা যায়।

তারপর হঠাৎ একদিন সব ছেড়েছুড়ে দিয়ে মেয়াদ শেষ হবার বহু আগে শহর থেকে দুরে এই মফস্বলে চলে আসেন।এখানেই জমি কিনে বাড়ি করেন, বাড়ির নাম দিয়েছেন “অতিথি”।

যদিও এ নামের যথার্থতা শঙ্খর মাথায় ঢোকেনা, শুভ্রবাবুর তিনকুলে কেউ নেই এমনকি কোন বন্ধু বান্ধবীও কখনো আসেনি। অতিথি বলতে তিনি কাকে যে বুঝিয়েছেন তা তিনিই জানেন।

সে যাইহোক, বাড়ি থেকে দুরে পড়াশোনার জন্য থাকতে গিয়ে কোন জায়গা পাচ্ছে না শুনে শুভ্রবাবু সঙ্গে সঙ্গে তাকে নীচের তলা ফাঁকা করে দেন, তবে এর জন্য তিনি কোন মাসিক ভাড়া বা সেরকম কিছু নেন না। খাওয়াদাওয়াটা পর্যন্ত তিনিই দেখেন, মিনা মাসি তাদের দুজনের জন্যেই রান্না করে, যাবার সময় তার ঘরে খাবার দিয়ে যায়। এভাবেই আজ প্রায় বছর খানেক হতে চললো।

(৩)

প্রথমবার যখন অতিথি হয়ে শহর থেকে দুরে এই দীনাগড়ে আসেন বহু কারনেই শুভ্রবাবুর মন ছিলো চঞ্চল, ভেবেছিলেন কেজানে কতদিন টিকবেন  এখানে কিন্তু আস্তে আস্তে মায়ায় জড়িয়ে গেছেন।
রোজ সকালে যখন সাইকেল করে বাজার যান; সকালের কাগজ দিয়ে যাওয়া ছেলেটা তাকে দেখলে হালকা হেসে কাগজটা তার ব্যাগে পুরে দেয়, আবার চায়ের দোকানের চাচা একটু বেশি করেই চা দেয়, কিন্তু এসব  শুভ্রবাবু তাদেরকে বেশি বকসিস দেয় বলে করে না, শুভ্র বাবুর কাছে এ একরকমের ভালোবাসা।
 চারপাশের গাছপালা সকালের নরম রোদে পাতার ভিড়ে লুকিয়ে থাকা পাখির কিচিরমিচির সব মিলে মিশে জায়গাটাকেও ভালোবেসে ফেলেছেন তিনি।
যদিও ‘ভালোবাসা’ শব্দটার প্রতি তার অতীত সম্পর্ক খুব একটা ভালো নয়।

শঙ্খ ঘরে চলে যাওয়ার পর এসবই ভাবছিলেন তিনি, বারান্দার ইজিচেয়ারটায় গা এলিয়ে দিতে ভাবনারা যেনো আরো বেশি করেই মাথা চাড়া দিয়ে উঠলো।

মা মারা যাবার আগে যখন সুস্থ ছিলেন তখন বিয়ে না করার জন্য খুব বকবক করতো। শুভ্র বাবু কখনো কানে দেননি সেকথা, জীবনে যাকিছু তিনি করেছেন সবকিছু মা আর বাবার কথা মাথায় রেখেই আর তা করতে গিয়ে নিজের জন্যই কিছু করা হয়ে ওঠেনি, অস্বাভাবিক মনে হলেও এটাই সত্যি।

জীবনের প্রতি সমস্ত চাওয়া-পাওয়া শুভ্রবাবু সময়ের ওপর ছেড়ে দিয়েছেন। আর মা মারা যাবার পর জীবন থেকে কিছু পাবার আশাও তিনি করেন না।

জীবনে কেবলমাত্র একটি জিনিস তিনি স্বইচ্ছায় করতে পেরেছেন তাহলো এই অবিবাহিত হয়ে থাকা। মা বেঁচে থাকাকালীন কখনো কিছু মনে হয়নি, কিন্তু চলে যাবার পর শুভ্র বাবুর জীবনের সবচেয়ে প্রিয় বন্ধু তার সাথে বিশ্বাস ঘাতকতা করেছে।

যে অন্ধকার; যে একাকীত্ব কে আঁকড়ে ধরে সে এতোদিন কাটিয়েছে সবকিছুকে অনায়াসে দুরে ঠেলে দিয়েছে সেই বন্ধুই শেষে শুভ্র বাবুকে নিজের আলিঙ্গনে এমন আবদ্ধ করেফেলেছে যে শুভ্রবাবু বাঁচার রসদটুকুও হাতড়ে বেরিয়ে  শেষে ক্লান্ত হয়ে পড়েছেন।

শুভ্র বাবুর জীবনে নারীসঙ্গ তার মা চলে যাবার সাথে সাথেই শেষ হয়েছে। তার এই অবিবাহিত থাকার  পেছনেও একটা ইতিহাস আছে।

(৪)

শুভ্রবাবুর দীর্ঘ জীবনে নারীসঙ্গ প্রাপ্তি খুবই কম হয়েছে, তার কারন  মেয়েদের প্রতি তার  লুকিয়ে থাকা,  নিজেকে গুটিয়ে রাখা। এ অভ্যাস তার বহুদিনের বলা ভালো সারাজীবনের।

তবে যে কজন নারী তার জীবনে এসেছে তার প্রত্যেকেই খুব ভালোভাবে মনে আছে, প্রত্যেকটি চরিত্রকেই খুব সাজিয়ে গুছিয়ে  নিজের মনের আলমারি তে স্থান দিয়ে়ছেন।

না; সবাইকে হয়ত দেননি।

আজও মনে পড়ে শ্রেয়সী যখন তার জন্য চার মাথার মোড়টায় অপেক্ষা করে থাকতো, তারপর দুজনে একসাথে টিউশনে যেতো।

তাদের সেই যাওয়ার সময়টায় কেউ কোনো কথা বলতো না,একে অপরের দিকে আড়াল থেকে লক্ষ্য রাখতো।

সেই স্কুল থেকে কলেজ অনেক কিছুই কাটিয়েছে ওরা। যখন সময় এসেছে তখন দুজন দুজনের অপেক্ষায় থেকেই রয়ে গেছে। শুভ্রদীপ এর সাহস করে বলে ওঠা হয়নি “আমি ভালোবাসি তোকে, তুইও কি বাসিস আমায় ঠিক ততটাই ভালো?”

তবে শ্রেয়সী কিন্তু সাহস দেখিয়ে ছিল আর দ্বিধায় ফেলেছিল শুভ্রদীপকে। বাড়ির অবস্থা তখন ভালো নয় তাও বাবা পড়াশোনাটা কোনরকমে চালিয়ে যাচ্ছে, তার স্বপ্ন তার ছেলে; একমাত্র ছেলে, একদিন আকাশ ছোঁবে।

মা-বাবা কেউ বেঁচে নেই আজ, শুভ্রদীপও আকাশ ছুঁয়েছে কিন্তু মাটির কাছাকাছি থাকা সবকিছুকে হারিয়ে।

সেদিন একবার যদি কথা বলতো, একবার যদি সব ভুলে শ্রেয়সী কে আরো অপেক্ষা করতে বলতো, ভুল কিছু হতো কি? তখন তো অন্যায় মনে হয়েছিল। তার জন্য শ্রেয়সীর কষ্ট পাওয়া না পাওয়ার হতাশা দন্ডহীন অপরাধ মনে হয়েছিল, আজও কি তাই মনে হয় আর?

স্পষ্ট মনে আছে এক বন্ধুর দেওয়া সেকেন্ড হ্যান্ড ফোনটা সেদিন সন্ধ্যায় হঠাৎই বেজে উঠেছিল। আর ফোনের ওপার থেকে সেই চেনা কন্ঠস্বরে প্রশ্ন এসেছিল –

হ্যাঁ, হ্যালো দীপ?

ধড়ফড় করে উঠে বসলেন শুভ্রবাবু, কখন যে বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা আর চোখ লেগে গেছে তার…

সেই সন্ধ্যার আধো-আলো অন্ধকারে তিনি চশমা ছাড়া অস্পষ্ট চোখে দেখলেন সামনে মিনা দাঁড়িয়ে,
আর আবছা আবছা শুনতে পাচ্ছেন মিনা বলে চলেছে রাতের খাবার কি হবে বল্লেননি তো বাবু!

Please rate this Post

5/5 (3)
  • লেখার স্টাইল আলাদাই.. ❤️❤️ আর চিন্তা ভাবনাও.. শর্ট ফিল্ম বানানোই যায় ✨

    Gobinda Gorai April 6, 2023 11:09 pm Reply

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *