একটুকরো বসন্ত – জলফড়িং

একটুকরো বসন্ত - জলফড়িং Meghpori

একটুকরো ন্ত – জলফড়িং

(১)

অর্নব…অর্নব…
অ্যাই অর্নব…

— চা না কফি?
— তুই তো চা-ই নিবি?
জবাব না দিয়েই অর্নব আওয়াজ দিল
— কাকা দুটো বড়ো চা এইদিকে।

অর্নব সামনেই কফিহাউস বা কোন রেস্টুরেন্টেই যেতে চেয়েছিল সরমা-ই যেতে চায়নি, জোর করে সামনেই একটা ছোট দোকানে দাঁড়করালো।
অর্নব ভবিতব্যে বিশ্বাস করেনা, আবার ও এটাও মানে সব কিছু ঘটার পেছনে সব সময় যে একটা কারন থাকবেই তার কোন মানে নেই। অনেক সময় লোকজন কেন তার সাথে এটা হল-ওটা হল না সেই ভেবেই বর্তমান সময়টা নষ্ট করে দেয়, হয়ত সে ঘটনা আদপেই মূল্যহীন একটা দূর্ঘটনা মাত্র।

তাই বছর পনেরো বাদে সরমা-র সাথে দেখা হওয়াটা ঠিক কোন শ্রেনীতে ফেলবে ভবিতব্য না দূর্ঘটনা সে বুঝে উঠতে পারলো না।
সময় পেলে মাঝেমধ্যেই কলেজস্ট্রিট আসে অর্নব কিছুটা বইয়ের টানে আর কিছুটা কলকাতার ধুলোবালি মাখতে। আজকেও এসেছিল, ফেরার সময় বাস ধরার জন্য দাঁড়িয়ে, ভিড়ের মধ্যে আগের বাসটা মিস গেছে।
পরেরটা নাকি মিনিট পাঁচেক পরেই আছে, তাই মন দিয়ে চলন্ত বাসগুলোর গায়ে নানারকম আঁকিবুঁকি আর বিজ্ঞাপনগুলো দেখতে দেখতে সে হারিয়ে গেছিল। হঠাৎ নিজের নাম শুনতে পেয়ে ধাক্কা খেয়ে পেছন ফিরতেই নিজের অজান্তেই ঠোঁট দুটো কেঁপে উঠল-
— সরমা!

(২)

গরম পড়ে গেছে, কলকাতা তো তাই গরমটা আরো বেশি করেই জড়িয়ে ধরে শহরটাকে। তাও ওই অল্প কিছুক্ষনের জন্য অর্নবের মনে হয়েছিল শেষ বসন্ত যেন যাওয়ার আগে তার সমস্তটুকু নিয়ে সরমা-র কাছেই থমকে গেছে।
আগের থেকে রোগা হয়েছে সরমা, সে বরাবরই স্বাস্থ্যবানছিল তো তাই চোখেলাগল ব্যাপারটা তবে মোটা বলা চলে না কোনোমতেই।
এই মোটা-রোগা, লম্বা-খাটো, ফর্সা-কালো,সুন্দর -অসুন্দর জিনিসটা বড়ই গোলমেলে আর বিরক্তিকরলাগে অর্নবের। কে যে কার কাছে কি, কতটা প্রিয়, তাকি অন্যজন তার মাপদন্ডে বলে দিতে পারে?

এটাই প্রথমবার নয় যে সরমাই প্রথম দেখে কথা বলতে এগিয়ে গেছে। এর আগেও বহুবার এমন হয়েছে, হয়ত একই রাস্তা দিয়ে একই দোকানে পাশ দিয়ে যাচ্ছে কিন্তু অর্নব তাকে খেয়াল করেনি অথচ সাধারণ মানুষের অত পাশে থাকলে চোখে পড়াটাই স্বাভাবিক।
অর্নব অবশ্য বলে সে রাস্তায় আপন মনে হাঁটে কোনদিকেই তখন নাকি তার হুঁশ থাকে না। সত্যিই কি তাই? কে জানে..

অর্নবকে সে স্কুল জীবন থেকে চেনে এমন অনেক খুঁটিনাটি সে জানে যা হয়ত বাকিদের জানার কথা নয়, কিন্তু তাও সরমার মনে হয় অর্নব কে যেন এখনও পুরোপুরি জানা হয়ে ওঠেনি ওর, হয়ত এখনো চেনেই না।

(৩)

অর্নব সরমাকে লক্ষ্য করেছিল অনেক আগেই। বাসটা মিস হওয়ার পর যখন এদিকওদিক উঁকি মারছিল তখনই দূর থেকে তাকে এইদিকে এগিয়ে আসতে দেখেছে সে।
সরমাকে দেখলেই অর্নব কেমন যেনো গুটিয়ে পড়ে, যেনো লুকোতে চায়। তাকে দেখলেই অদ্ভুত একটা ভয় জাগে অর্নবের বুকে, কেন তা সে নিজেও জানে না। প্রচন্ড ইচ্ছে হয় এগিয়ে গিয়ে কথা বলার কিন্তু শেষমেষ বুকের দামামাটা জিতে যায়, পাশ কাটিয়ে চলে যেতে হয় যেমনভাবে জীবনের সমস্ত চাওয়া-পাওয়াগুলোকে গলির মোড়ে মোড়ে ফেলে আসতে হয়েছে ঠিক সেইভাবে।

কলকাতার এই দুপুরে কোন এক চায়ের দোকানে বছর পঁত্রিশের দুই যুবক-যুবতীকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা কোন অস্বাভাবিক কিছু নয়, কিন্তু তাও এই ব্যাস্ত স্রোতের ভিড়ে ঐ দুজন মানুষকে দূর থেকেই আলাদা করা যায়। কেমন যেন আড়ষ্টভাব দুজনেরই, ওদের কেউই কথা বলছে না। হয়তবা চোখ যাচ্ছে কান ঘেঁষে কিন্তু চোখাচোখি হলেই আবার মন চায়ের ভাঁড়ে।

— তারপর এদিকে, কলেজে নাকি?
কথাটা অর্নবই প্রথম বলল।
— কলেজে পড়ার বয়স কি আর আছে? সেসব দিন তো অনেক আগেই ঘুচে গেছে।
প্রশ্নটা করেই নিজেকে বোকা মনে হল আর একই সঙ্গে হতাশ হল। আসলে কিভাবে কথা শুরু করা যায় তাই ভাবছিল, আর তা করতে গিয়েই সব গুলিয়ে গেছে, কি যে বলছে ও নিজেও জানে না।
— না মানে বলছিলাম…
— আর মানে মানে করে লাভ নেই।
চায়ের ভাঁড় টা ডাস্টবিনে ছুড়ে অর্নবের দিকে তাকায় সরমা। সে চোখে যেন আদেশ আছে, যাদু আছে চুপ করিয়ে দেবার।
— এবার বাড়ি ফিরবি তো?
ভয়ে ভয়ে প্রশ্ন করে অর্নব
— হ্যাঁ
— বাসে?
— নয়ত আর কিসে যাওয়া যায়? অবাক চোখে তাকায় সরমা
— তুই চাইলে হেঁটে ফেরা যায়
এখান থেকে হাওড়া মিনিট কুড়ির হাঁটা পথ অর্নবের যখন বয়স উনিশ-কুড়ি বাস ভাড়া বাঁচাতে তখন প্রায়ই হেঁটে যাতায়াত করত সে। সেই পথের কোন সঙ্গী ছিল না তখন, আজ তার সে সুযোগ হবে কি?

(৪)

বয়স বেড়েছে তাই কষ্ট একটু হচ্ছে হাঁটতে, পনেরো বছর সময়টাতো কম নয়! অর্নব ভাবে সরমা’রও বোধহয় কষ্ট হচ্ছে। যে মেয়েটা চিরকালই কিছু বলল না আজ আর কি বলবে। সে খেয়াল করল চারপাশের দোকানপাট আগের থেকে অনেক বদলে গেছে।
এত ঘিঞ্জি আর চেঁচামেচির মধ্যেও সরমা’র শ্বাস- প্রশ্বাসের শব্দ স্পষ্ট টের পাচ্ছে সে। হঠাৎই অর্নবের মনে পড়ে সরমা’র শ্বাসকষ্টর কথা, চকিতে সে একবার তাকায় সরমা’র দিকে আর এক হেঁচকা টানে তাকে বসিয়ে দেয় ফুটপাতের পাশের সুবিশাল বাড়িগুলোর একটার সিঁড়িতে।
ভালো করে চোখমুখ ধুইয়ে দেয় তার নিজেও নেয় কিছুটা। তারপর যেভাবে টেনে বসিয়েছিল ঠিক সেইভাবে টেনে তুলে হাঁটতে শুরু করে।

সরমা’র হাতের পাঁচটা আঙুল এখন অর্নবের হাতের মুঠোর মধ্যে, তারা যেন বেশ মজা পেয়েছে। লুকোচুরি খেলায় যেভাবে পালিয়ে লুকিয়ে বেড়াতে বেড়াতে শেষমেশ ধরা পড়ে যেতে হয়, সরমা’র মনে হল আজ তার অবস্থাও খানিকটা সেরকম।
অর্নবকে সে সবসময় বন্ধু হিসেবেই দেখেছে, আজও তাই। কিন্তু কখন যে সে নিজেই অর্নবকে ফেলে অনেক এগিয়ে গিয়েছে তা সে নিজেই খেয়াল করেনি।

— বিয়ে করেছিস?
নিজের মনকে বাঁধতে প্রশ্ন করে সরমা
— হ্যাঁ, আর তুই?
কিছুক্ষন চুপ করে থাকে সরমা, তারপর মুখ তুলে বলে
— যেটা তুই নোস সেটা হবার চেষ্টা করিস না, তুই জানিস আমি ধরে ফেলবো।
চা খাওয়ার সময় অর্নবের হাতদুটোর অগুনতি ফোস্কা সে দেখেছে। সরমাও অবিবাহিত তাই মা’র বয়স বাড়ার পর থেকে ওকে রান্নাঘরে ঢুকতে হয়েছে তাই ওই ফোস্কা কিসের তা ওকে বলে দিতে হয় না।
— তোর ধরার আগেই তো আমি ধরা দিয়েছি তুই আর দেখলি কই!
সরমা চুপ করে থাকে অর্নবের এ কথার কোন জবাব ওর কাছে নেই, হাতটা ছাড়িয়ে নেয় সে।

(৫)

অদ্ভুত সব চিন্তা ভাবনারা ভিড় করে আসছে, তারা অর্নবের মন মস্তিষ্কেকে কব্জা করতে চায় কিন্তু তার থেকে বেরোনোর কোন পথ তার জানা নেই। কখন যে ব্রিজের ওপর চলে এসেছে খেয়াল হয়নি।
অর্নব সরমার দিকে তাকায় হাওয়ায় তার শাড়ি উড়ে যাবার জোগাড়, অন্যমনস্ক হয়ে কি যেন দেখছে সে।

সরমা ওপর থেকে নীচে তাকায় একবার, তার বুকটা ছ্যাৎ করে ওঠে। গাড়ি ঘোড়ার বিরামহীন চলাচলের ঝাঁকুনিতে কেঁপে কেঁপে উঠছে তার পা। ওর মনে হল গঙ্গার জলে যেন কেউ আগুন জ্বেলে দিয়েছে। বিকেলের শেষ রোদে জলের ছোট ছোট স্রোতগুলো এলোমেলো ভাবে ভিড় করে আসছে আর মিলিয়ে যাচ্ছে কোথায় যেন একটা, অনেক লক্ষ্য করেও তা ধরতে পারল না সে।

— তুই সেই একই আছিস অর্নব, পনেরো বছর আগে যেমনটা ছিলিস; সহজ সরল, ঢ্যাঙা সেই ছেলেটা যে আজও গুছিয়ে মিথ্যে বলতে পারে না।
— পুরনো হয়ে গেছি বলছিস?
— জানি না, কিচ্ছু জানিনা আমি।আমার সব কেমন গুলিয়ে যাচ্ছে অর্নব।

দুহাতে মুখ ঢাকে সরমা, নদীর নোনা জলের মতোই স্রোতেরধারা নেমে এসে তার চিবুক দখল করে। এগিয়ে যাওয়ার সাহস হয় না অর্নবের।
ব্রিজের ওপর থেকে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে হাওড়া রেলওেয়ের জ্বলজ্বল করতে থাকা লাল ঘড়িটা। একথা অস্বীকার করা যায় না সত্যিই পুরনো হয়েছে সে, পনেরো বছর ধরে যাকে বয়ে বেড়াচ্ছে সে ধূলোর স্তর আর কিছুটা বাড়লেই ঢেকে ফেলবে অর্নবকে।

এক জায়গায় বেশিদিন থাকলে জায়গা পুরনো হয় না পুরনো হয় সেখানে থাকা মানুষটা, পরিবর্তনের নিয়মে পুরানোরা চলে গেলে নতুন মানুষ আসে তাই জায়গাও নতুন হয় তখন।
কাঁদতে কাঁদতে খুব একালাগে সরমার, অর্নবকে জড়িয়ে ধরতে ইচ্ছে করে খুব। মুখ থেকে হাত সরাতেই দেখে সে নীচের সাবওয়েতে, চারপাশে অফিস ফিরতি মানুষের ঢেউ সেই ঢেউ তাকে ঠেলতে ঠেলতে নিয়ে চলেছে, এদিকওদিক তাকায় সে অনেক খোঁজাখুঁজি করে, অর্নব-কে কোথাও দেখতে পায় না…

— কাকা দুটো বড় চা এই দিকে…

হতেপারে সবার জীবনে বসন্ত আসে না কিন্তু সবারই টুকরো টুকরো বসন্ত ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকে হয়ত আমারা তাদের চিনতে পারিনা। তেমনই এক টুকরো বসন্তের গল্প “একটুকরো বসন্ত”।
গল্পে কিছু জায়গায় বাস্তবে অবস্থিত জায়গার উল্লেখ রয়েছে, লেখক গল্পের প্রয়োজনে তার সাথে কল্পনার সংমিশ্রণ করেছেন। তাই বাস্তবের সাথে কোন মিল থেকে থাকলে তা সম্পুর্ন কাকতালীয়ও অবাঞ্ছনীয়।

Please rate this Post

4.33/5 (3)
  • বাস্তব জীবনের সঙ্গে অনুভবের জোয়ার..☺️💕
    এইভাবেই আরও লেখা উপহার দিতে থেকো.. 🌼💙

    Gobinda Gorai April 6, 2023 11:12 pm Reply

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *